রেনেসাঁ, শিল্পবিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লব ইউরোপে যে জীবন ও বস্তুবাদী, রোমান্টিক, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবতাবাদী চিন্তা ও চেতনার জন্ম দিয়েছিলো তার তিন সার্থক রূপকারের একজন কাজী নজরুল ইসলাম। বাকি দু’জন মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ। চর্যাপদ, রাধাকৃষ্ণকেন্দ্রিক বিবিধ গীতিকবিতা, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, পুঁথিসাহিত্য, মঙ্গলকাব্য ও লোকসাহিত্যের মধ্যযুগীয় কাব্যরীতি, বিষয় ও চৈতন্যের অবসান ঘটিয়ে তার জায়গায় এ তিন কবি উক্ত তিন ঘটানাপ্রভাবিত ইউরোপিয় আধুনিক সাহিত্যের নতুন ধারার উত্থান এবং সার্থক রূপায়ণ ঘটান। ইংরেজের আনিত, আমদানিকৃত, প্রতিষ্ঠিত, প্রতিস্থাপিত শিক্ষা, যন্ত্র, প্রযুক্তি, উন্নয়ন আর তার থেকে বিচ্ছুরিত আলো ভারতবর্ষে আত্মবোধন ও জাগৃতির যে প্লাবন সৃষ্টি করেছিলো তা ভারতবর্ষের নবশিক্ষিত মানুষকে গুরুমারা বিদ্যায় প্রশিক্ষিত করে তুলে। এ বিদ্যা ভারতবাসীকে বুঝতে শেখায় যে তারা পরাধীন আর তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা অতি-আবশ্যক। সেই সাথে মধুসূদন বাদে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলে বিশেষ করে নজরুলে এর পূর্ণাবয়ব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
মধুসূদনের বিদ্রোহ ব্যক্তির আত্মজাগরণ ও মানবিকতা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকলেও রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলে তা রাজনৈতিক চেতনায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের চাইতে নজরুলের মধ্যে এর সরব, তীব্র, শানিত ও সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যক্ষ করা যায়। সেই সাথে এই দুই কবির সাহিত্যে প্রথম মহাযুদ্ধ ও রুশবিপ্লবের অভিঘাতজনিত যন্ত্রণা, জীবনযুদ্ধ, হতাশা ও আকাঙ্ক্ষার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। এর প্রভাবে পাল্টে গেছে কাব্যের ভাষা, বিষয়, অলঙ্কার। রবীন্দ্রনাথে এসব ঘটনার প্রেক্ষিতসৃষ্ট তিরিশোত্তর কাব্যান্দোলনের মূল প্রেরণা, ধরন ও আঙ্গিকের সার্থক প্রয়োগ ঘটলেও নজরুলে আঙ্গিকের বদলটি অনুপস্থিত। তবে শাসকের বিরুদ্ধে নজরুলের সচেতন ও সুতীক্ষ্ণ বাণছোঁড়া আক্রমণাত্মক রাজপথের ভূমিকার উপস্থিতি রবীন্দ্রনাথে অপেক্ষাকৃত কম। সেক্ষেত্রে নজরুল অনেক বেশি রাজনীতি ও শ্রেণিসচেতন। দু’য়ের এটা একটা মৌলিক পার্থক্য।
এ ত্রয়ীর সাহিত্যের ধরন, বিষয়, উদ্দেশ্য ও উপস্থাপন কৌশলে মিল ও অমিল দুটোই আছে। মহাকাব্য, অমিত্রাক্ষর ছন্দ, মনুষ্যত্বের বিদ্রোহাত্মক আত্ম-উদ্বোধন মধুসূদনের কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মানুষের মনোজগতের গভীরকথা, অন্তর্দহন, হৃদয়জ প্রেম, প্রকৃতির বিস্তৃত সুন্দর, প্রাত্যহিক জীবনের দ্বন্দ্বমুখর বেদনা ও সুখাভাসিত তীব্র জীবনপ্রেম আর অধ্যাত্মবোধ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির মূল ভাণ্ডার।
আর নজরুল? নজরুলকে উনিশ শতকের পরাধীন ভারতবর্ষের জনচিত্ত ও জনআকাঙ্ক্ষার মানসপু্ত্র বলা যায়।
মধুসূদনের মতো তিনি বিদ্রোহী, রবীন্দ্রনাথের মতো মানবপ্রেমী। সেই সময়ের, তার আগের এবং পরের যত ইতিবাচকতা তাঁর মধ্যে উপস্থিত, যত নেতিবাচকতা থেকে তিনি যোজন যোজন দূরে অবস্থানরত। সবে জেগেউঠা, স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় নিবেদিত, সংগ্রামরত, ইংরেজবিরোধী সশস্ত্র যুদ্ধে ব্যস্ত ভারতবাসী সেসময় হিন্দু ও মুসলিম এই সাম্প্রদায়িক জাতিসত্তায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও নজরুলের মধ্যে তার চুল পরিমাণও আঁচড়ের দেখা যায় না । বরং প্রবল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই কবি কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, শিশুতোষ রচনায়, প্রবন্ধে, সাংবাদিকতা-পত্রিকা সম্পাদনায়, সঙ্গীতে, ব্যক্তিজীবন, সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, চিন্তা ও চৈতন্যে, মানুষ, নারী, জাত-ধর্ম-সম্প্রদায়, রক্ত গোষ্ঠী চেতনায় নিরবচ্ছিন্ন মানুষের গুণগানে মুখর হয়েছেন। তার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় যখন তিনি বলেন “হিন্দু না ওরা মুসলিম” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন। কাণ্ডারি! বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র!” এর প্রতিফলন তাঁর লেখা গানে বিস্তর মেলে।
একদিকে ইসলামি অন্যদিকে শ্যামাসংগীত রচনা করে তিনি তার প্রমাণ রেখেছেন। এই অসাম্প্রদায়িকতা বাঙালির আদিসংস্কৃতি। একই গ্রামে, পাড়ায়-মহল্লায় বহুকাল ধরে বাস করে এসেছে বাঙালি। একই নদীর, বিলের মাছে রসনা তৃপ্ত, হিন্দুবাড়ির পৌষসংক্রান্তির পিঠা মুসলমান পড়শি আর, আর মুসলমান বাড়ির মুড়কি-লাড়ু ঘরলাগোয়া হিন্দু বন্ধু ভাগ করে করে খেয়েছে। গোসল বলি আর স্নান এক ঘাটে করেছে হিন্দু-মুসলমান। পান করেছে লোকগান ও সংস্কৃতির অমিয় সুধা। নজরুলে এ দু’য়ের হাজার বছরের মিলনের গীত রণিত হওয়ায় তিনি খাঁটি বাঙালি কবি। তবে তাঁর বিদ্রোহ মধুসূদনের মতো নিয়তিবিরোধী নয়, আপাত ভগবতবিরোধী মনে হলেও সে ভগবান সমাজের উচ্চশিখরে দাঁড়িয়ে মানুষকে অপমান করছে যে অশুভ শক্তিধর নিষ্ঠুর নির্যাতক সেই মানুষরূপী ভগবানের বিরুদ্ধে।
তিনি জানেন যে এই পশুরাই মনুষ্যত্বের মাথাকে মাটির তলায় পিষে ফেলে অবলীলায় লুণ্ঠিত করে। তিনি প্রত্যক্ষ করেন এদের অবস্থান যেমন সমাজের রন্ধ্রে নিশ্চিত বাসরত ধনিক-অত্যাচারীতে, তেমনি সাতসমুদ্রের ওপার থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা বিদেশী শাসকে। তিনি একইসাথে তাই বিদেশী শাসকবিরোধী স্বরাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নবিভোর কবি, মনুষ্যত্ব ও মানবিকসাম্য প্রতিষ্ঠার মানবতাবাদী এবং অচেতন-শ্রেণিসচেতন কবি। একথা বলছি এজন্য যে ‘দারিদ্র্য’ কবিতায় তিনি এ দু’য়ের দ্বান্দ্বিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। একইসাথে এতে দারিদ্র্যের মহত্ত্ব, যিশু খ্রিষ্টের মহত্ত্বের সাথে তুলনা, আবার ‘অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’ বলে সর্বহারার হারাবার কিছু নেই এই মার্ক্সিয় তত্ত্বের যুগল দ্বৈরথ বা দ্বন্দ্ব হাজির করেছেন। অথচ তাঁর ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সর্বহারা’ কাব্যের কবিতার দিকে তাকালে তাঁকে খাঁটি মার্ক্সবাদী কবি বলেই মনে হয়। এসব কবিতায় শুধু নিপীড়িত মানুষের শোষণ-বঞ্চনার চিত্রই নয়; শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা, ক্রোধ, ক্ষোভ, বিদ্রোহ ও বিপ্লবের আহ্বান উচ্চারিত ও প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
বস্তুত এর সবই—- কবিতার এই বৈচিত্র্যময় প্রকাশ ঘটেছে মানুষের জন্য তাঁর সত্যিকারের প্রেমবোধ থেকে। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রেমিক কবি। প্রেমই তাঁর কবিতার প্রধানতম উপজীব্য। সে প্রেমের স্বরূপও বিচিত্র। কখনো তা নারী, কখনো প্রকৃতি, কখনো অবমানিত-অপমানিত মানুষের মর্মযন্ত্রণা, কখনো শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের মনের কথার পরিভাষায় প্রকাশিত। কখনো মনে হয় তিনি ধর্মবোধে আচ্ছন্ন, কখনো ধর্মবিরোধী নাস্তিক, কখনো রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী আবার কখনো শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার মার্ক্সিয় চেতনা-উদ্বুদ্ধ শ্রেণিসচেতন কবি। আর এ সবের মূলে কাজ করেছে তাঁর প্রেমচেতনা। সে প্রেমের মূল উৎস মানুষের জন্য ভালোবাসা।
নর-নারীর চিরন্তন জৈবিক যে প্রেমের কবিতা তিনি লিখেছেন তা শুধু তাঁর নিজেরই নয়, মানুষেরই যাপিত জীবনের সহজাত, স্বভাবজাত শরীর ও মনোভুবনের প্রতিকথা। নারীর মর্মব্যথা কিম্বা হিমালয় পর্বত বিদীর্ণকরা অথবা অবনতকরা মানুষের যে শির আকাশ ছুঁয়ে ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছে তা মানুষের মধ্যে জেগে উঠা আত্মোদ্বোধিত নয়া মানুষের সদম্ভ অস্তিত্বের প্রমাণ— যার নাম মানবতাবাদ। আবার যে বিদ্রোহ তাঁর কলম থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়েছে তা আত্মবোধে উদ্বুদ্ধ স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষাী ভারতবাসীর মনের ইচ্ছারই প্রতিফলন। এতোকালের অচেতন যে মানুষ ভগবান ও রাজানুগত্যকে বিধির বিধান বলে মেনে নিয়েছে তিনি তার শিকড় ধরে টান দিয়েছেন, উল্টে ফেলতে চেয়েছেন। আর শেষতক কুলি ও মজুরের,কৃষক ও শ্রমিকের পক্ষে দাঁড়িয়ে যখন তিনি উচ্চারণ করেন—
(আজ) চারিদিক হতে ধনিক বণিক শোষণকারীর জাত,
(ও ভাই) জোঁকের মতন শুষছে রক্ত কাড়ছে থালার ভাত
অথবা,
এবার জুজুর দল ঐ হুজুর দলে
দলবি রে আয় মজুর দল।
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল।
তখন তাঁকে শ্রেণিসচেতন সর্বহারার কবি না বলে উপায় থাকে কি?
বস্তত, যেমনটা বলেছি এর সবকিছুরই উৎসভূমি মানুষ। মানুষের জন্য তাঁর ভালোবাসা। মানুষের মর্মবেদনা, পরাধীনতার গ্লানি, বিদেশী শাসনপিষ্ট আত্মঅবমাননা ও অন্তর্যন্ত্রণা তিনি ধারণ করেছেন নিজে, তারপর উদ্গার করেছেন কবিতায়। তাঁর নারী প্রেম, মানবিক আবেদন, বিদ্রোহ, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, বিপ্লবের আহ্বান, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী ডাক এসবের অন্তর্গূঢ় অন্তস্থলে অবস্থিত ছিলো মানুষ, মানুষের জন্য নিরন্তর মানবিক প্রেম। তাঁর বিদ্রোহ-বিপ্লবের উৎস তাই শুধুই মানুষ।
এসব বিবেচনায় বলা যায় তিনি, কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের কবি। তাঁর কবিতা, সমস্ত রচনা, জীবন আর কর্মকাণ্ড মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত।