কবিতার জগৎ মূলত কবির চিন্তার জগৎ। যেখানে কবি নির্মাণ করেন কবিতারই ছায়াছবি।তাই কবিতার কাছে পাঠকের প্রত্যাশা ব্যাপক বিচিত্র, অভিনব এবং অন্তহীন। বলা হয়ে থাকে, কবিতার ইতিহাস তার প্রকরণ প্রকৌশলের ইতিহাস। সেই দিক থেকে কবি সুরঞ্জিত বাড়ই এর দ্বিতীয় কবিতার বই ‘ক্রমাগত ভাঙন থেকে’ কবির সৃজনশীলতার শক্তি ও স্বতন্ত্র চিহ্নিত হয়।
যেখানে তিনি তার কল্পনাশক্তি ও চিন্তার রেখায়নের ঔজ্জ্বল্য অনেকাংশেই অক্ষুণ্ন রেখেছেন।
এইবার তার কবিতার নৈপুণ্যের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করি:
‘ফুলে ফুলে মাতাল দৃশ্য
আমার আঙিনায় বাসা বাঁধে প্রেম
খড়কুটো বড় বেশি প্রয়োজন আজ ‘
/পাঠ
কবিতায় তিনি প্রকৃতি প্রেমকে এভাবেই রসাস্বাদন করেছেন। যা পাঠক কখনো গালগল্প ভেবে প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না। প্রকৃতির মগ্নতাকে তিনি যেমন হৃদয়ে ধারণ করেছেন,তেমনি তার দেখার চোখকেও এতে চিত্রিত করেছেন।
সুরঞ্জিত বাড়ই এর কবিতায় কোন স্পেস নাই, যার দরুন কবিতাকে একলাশা মনে হয়। সচেতন কোন চিন্তা এর পেছনে কাজ করেছে বলে আমার মনে হয় না। দেখা গেলো এটা তার স্বভাবজাত। তিনি আসলে কবিতার এই পরিমন্ডলকেই ভালোবেসেছেন। আবার যখন দেখতে পাই তার কবিতায়-
একটা বাক্য হয়তো শেষ হয়ে গেছে একটা পংক্তিতে, ঐ একই পংক্তিতে আরেকটা বাক্য শুরু করার প্রবণতা তার কবিতায় খুবই কম।
‘কার প্রতীক্ষায় নিজেরে সাজায়ে রাখো তুমি
ধরে রাখো একটি জলজ জীবন
শিশির ভেজা সজীবতা দেখাও
সূর্যের নিদারুণ তাপ সয়েও
কী করে এত কোমল তোমার মন
এই যে এত অবহেলা,
এত করুণা তুমি নিরবে সয়ে যাও
কার প্রতীক্ষায়’
/পানাফুল
‘ক্রমাগত ভাঙন থেকে’ কবিতার বইটিতে তিনি কিছু সিরিজ কবিতা রেখেছেন। যা আমাকে সেভাবে টানেনি। যা কোন কাব্যগ্রন্থের ম্যাচিউর সত্তাকে পোক্ত করে না বলে আমি মনে করি। তবে হ্যাঁ যদি কখনো তিনি সামনে বই করেন অবশ্যই এই দিকটা নজরে রাখবেন।
‘ যদি দেখতে চাও ঈশ্বরের ঘুম
যদি শুনতে চাও তাঁর বাঁশির সুর
তবে চলে এসো বন্ধু ইয়েমেনের পথে পথে’
/ঘুম
এখানে তার আত্মচৈতন্যের গভীরতা কতটা তীক্ষ্ণ ও প্রগাঢ় তা বুঝতে পাই। বৈশ্বিক পরিস্থিতির ভাবনায় ইয়েমেনের নিপীড়িত ক্ষুধার্ত শিশুদের চিত্র তুলে ধরেছেন তার স্বোপার্জিত জ্ঞানে। এ রূপ প্রকরণেও তিনি, ‘ঈশ্বর’ কে নির্বিকার ভেবেছেন। আর এই ভাবনার ভেতর দিয়েই তিনি বের করে এনেছেন ক্ষমতার বিচিত্রতা। এখানে একটি দীর্ঘশ্বাসও ভেসে ওঠে-
‘একটি বৃক্ষজীবন পাইনি বলে
আমাদের প্রেম ফিরে আসে না আর’
/বৃক্ষজীবন
যদি ভাবি তবে ব্যক্তিগত অনুভব ও উপলদ্ধিতে তিনি বৃক্ষের জীবন কে অপরিহার্য ভেবেছেন।
সুরঞ্জিত বাড়ই কবি। তাই তার কবিতার বইটিতেও সচল উৎসারণ দেখতে পাই। উপমা, অলঙ্কারে যে ভাবে শব্দ ও কাব্য নিমার্ণ করেন; তাতে কবিতার বুনন স্বতন্ত্র রীতি নিয়েই দাঁড়ায়। কিন্তু এমনটি কি এমন, কবিতায় তিনি যা বুঝাতে চান হয়তো তার চেয়েও বেশি তিনি কবিতাকে ধরতে চান। তাই হয়তো জীবনের রসদ নিয়ে তাকে বলতে শুনি:
‘মৃত্যুশোক ভুলে বরং জীবনের কথা বলি
এই হেমন্তে সোনালী ধানের ক্ষেত
মিষ্টি রোদ্দুরের কথা বলি
/জীবনের কথা
একজনম, হেমন্তের ধানখেতের পাশে বসে যোজন দূরের পথের দিকে তাকিয়ে থেকেও কাটিয়ে দেওয়া যায়। কাটিয়ে দেওয়া যায় সমস্ত আড়াল খুলে শস্যের প্রেমে। কিংবা রোদের ক্ষয় ছুঁয়ে প্রজাপতির পিছনে ছুঁটে চলা অমিত সম্ভাবনায়।
একজনম, হেমন্তের ধানখেতের পাশে বসে যোজন দূরের পথের দিকে তাকিয়ে থেকেও কাটিয়ে দেওয়া যায়। কাটিয়ে দেওয়া যায় সমস্ত আড়াল খুলে শস্যের প্রেমে। কিংবা রোদের ক্ষয় ছুঁয়ে প্রজাপতির পিছনে ছুঁটে চলা অমিত সম্ভাবনায়। আহা তখন তারাশঙ্করের ‘কবি’ র গায়েন নিতাইয়ের মতন বলতে ইচ্ছে করে, ‘জীবন এত ছোট কেনে?এই ভুবনে? আমার এই যে বলা যা কেবল ইহকালই শোনে।
‘তখন শহরের চোখে ক্রমশ নিদ্রাসুখ
আর স্বপ্নেরা বিভোর হয়ে মিশে যায়
এইখানে এসো ভোরের বেলা
আয়মান তীর’
/এই শহরে- ২
নগরায়ন ও গ্রামীণ পটভূমির মিথস্ক্রিয়ায় বিশেষ একটা রূপ গ্রহণ করেছে তার এই কবিতাটি। অন্যভাবে বলা যায় নাগরিক মননের মধ্যেই তিনি গ্রামীণ অনুষঙ্গকে ধারণ করেছেন। যাই হোক এই ধারণ করার শ্রেয়তা তার ভেতর পরিশুদ্ধ।
সুরঞ্জিত বাড়ই স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটা হচ্ছে মানুষের উজ্জ্বল দিকগুলোর একটি। স্বপ্ন দেখতে না পারাটাও মানুষের একটি বড় দৈন্যতা। স্বপ্নের ভেতরে যে শৈল্পিক দাবি থাকে তা সুরঞ্জিত বাড়ই এর কবিতায় উপস্থিত থাকায় পাঠকের মনে এক ধরণের ব্যাকুলতা তৈরি করে:
‘ হে কৃষক-
এবার দখল নাও রাজপথের
শক্ত হাত উপরে ওঠাও
ধান আর মানের তরে
দ্বিধাহীন সংগ্রাম চালাও’
/কৃষক
‘এই শামুক জীবন
নুয়ে আছে ভীতির ভারে
চাপাতির ঘা আর ক্রসফায়ারে
স্বাদগন্ধহীন হয়ে আছে সব’
/স্বাদগন্ধহীন
আমাদের সমাজ – রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত যে লিডার – ক্যাডার যন্ত্রনায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে তারই একটি নিঁখুত চিত্র এই কবিতায় ফুটে ওঠেছে।
আরেকটা বিষয় লক্ষ্যনীয় সুরঞ্জিত বাড়ই শুধু কবি নন, একজন গল্পকারও। সুতরাং তিনি কবি এবং গল্পকার এই দুই সত্তা নিয়ে যখন লেখতে বসেন তখন কবিতায় তিনি গল্পটা করতেই পারেন। এই চিন্তাজাগাটাই স্বাভাবিক।
‘শীত শীত তাহার শরীর
এই শরৎভোর, শিউলিফোটা দিন বেঁচে থাক’
/এই শহরে- ৩
এই কার্তিকেও কবিতার স্রোতধারায় পাঠক শরৎভোরের সাথে হেঁটে যান। অতি সহজেই জেনে ফেলেন তার আবেগ। তার শব্দের অনুশাসন। যা কিনা কবির আত্মা থেকে কবিতার আত্মায় প্রতিধ্বনিত হয়। যদিও কল্পনা ও আবেগ, পরিবেশ ও ব্যক্তিত্ব কোনটাই নিরপেক্ষ নয়।
সুরঞ্জিত বাড়ই এর কবিতায় প্রকৃতি প্রেম নিয়ে ওঠে আসে সময়। দেখুন কিভাবে এই কার্তিকেও কবিতার স্রোতধারায় পাঠক শরৎভোরের সাথে হেঁটে যান। অতি সহজেই জেনে ফেলেন তার আবেগ। তার শব্দের অনুশাসন। যা কিনা কবির আত্মা থেকে কবিতার আত্মায় প্রতিধ্বনিত হয়। যদিও কল্পনা ও আবেগ, পরিবেশ ও ব্যক্তিত্ব কোনটাই নিরপেক্ষ নয়। সুতরাং গতানুগতিক জীবনের বাইরে তার এই ভাবনার বিচরণ, যদি বলি পাঠকের প্রত্যাশারই এক বিমূর্ত রূপ।
‘শেকড়ের গভীরতা কতটা জানে ঐ নির্বাক কবর
আমাদের ভালোবাসা বেদনা হয়ে ঝরে’
/অস্তিত্ব
প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক স্মরণে তার এই কবিতাটি এই কাব্যগন্থে মলাটবদ্ধ হয়েছে। যেখানে একটি সম্পর্কের আনাগুণা চিন্তাবিন্দুর এক অর্থ থেকে একাধিক অর্থের পুঞ্জ তৈরি করে। এই হারিয়ে যাওয়ার স্পন্দন আমাদের কেন আরও আরও অসহায় করে দেয়?
একজন সুরঞ্জিত বাড়ই কবিতার আড়ষ্টতা নিয়ে ভাবেন না। বরং তিনি স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে দীক্ষিত মননের সমন্বয় ঘটিয়ে কবিতাকে সাবলীল করে তোলেন। ‘ক্রমাগত ভাঙন থেকে’ কবির নিছক উচ্চারণ মাত্র নয়! যেখান থেকে কিছু কবিতার সম্মোহন যেন হাত বাড়ায় অনন্য শিল্পরূপে। আগামী কাব্যগ্রন্থ তিনি আরও ভালো করার স্বাক্ষর রাখবেন, এই প্রত্যাশা করি।