যাত্রার বিবেক গানে অনিবার্যই ছিলেন গৌরাঙ্গ আদিত্য। আলোকিত যাত্রাযুগে উজ্জ্বল মঞ্চে দর্শকের বিবেককে স্পর্শ করেছিলো গৌরাঙ্গের গান ও গায়কী। বাংলার মানুষ গান শুনে কাঁদে। গাইতে গাইতে কাঁদে। সেবা ও সহমর্মিতায়, প্রেম ও মিলনাকাক্সক্ষায়, আধাত্ম-প্রেম ও আচারিক প্রার্থনায় বাঙালির ঘরে সকাল-সন্ধ্যা গান বাজে। এই গান অন্তরজাত। মাটিজাত। গান গাইতে গাইতে সহজ বাঙালি সহজে অধরা ধরেন। পাপ ও পাপের শাস্তি থেকে মুক্তি লাভের আশায় রসিক বাঙালি নিজেকে নিজেই নিরূপন করেন। ‘জীবনে-মরণে সীমানা পেরিয়ে’ পরমকে খোঁজার এ এক আশ্চর্য চেষ্টা। পাপদগ্ধ বাঙালি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে। গানটা মূলত বাঙালির আত্মশুদ্ধির আয়োজন। পবিত্র মনের নিবেদন।
‘তুমি করেছ যত পাপ।
এখন কি আর কাঁদলে হবে মাফ।।
আর ভেবে দেখ পূর্ব পরে, যখন ছিলে বেহেস্তের ঘরে
গন্ধম খেতে নিষেধ করে, মাননি পবিত্র বাক।। [১]
এ যেন ভেঙ্গে ভেঙ্গে নিজেকে তৈরি করার নিবেদন। এ যেন তোমার কাছে আসবো মাগো, তোমার গানে। বাঙালির সংগীত সাধনার ভাব ও প্রকৃতির সাথে পৃথিবীর কোন সংগীতকে মেলানো যাবে না। প্রত্যেক ভূগোলে মাটির গানের ভাব ও প্রকৃতি ভিন্ন। মাটির গানের সুর ও স্বভাবকে ধারণ করেই বাঙালি সংস্কৃতির গান গেয়েছেন গৌরাঙ্গ আদিত্য। উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছেন সংগীতের ধারা। কিশোর বয়সেই মিশে গিয়েছিলেন কৃষ্ণলীলার দলে। গৌরাঙ্গ আদিত্য মূলত আসরের গায়ক। সারা রাত জেগে আসরের গানেই মুগ্ধ থাকে লোকায়ত বাঙালি। অগ্রহায়ণের ধান ঘরে তোলার পর খোলা মাঠে পেন্ডেল বেঁধে বসে গানের আসর। আজ রাতে এই গ্রামে আসর বসলে কাল বসবে অন্য গ্রামে। সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়ির বাংলাঘর কিংবা আলগ ঘরেও বসে এই আসর। বাংলার সহজ মানুষ আসরে বসে এভাবেই গান শুনে। গান শুনে শুনে তারা হয়ে উঠেন শুদ্ধ ও আক্ষেপহীন। শুদ্ধ ও সাধু বাঙালির কাছে গানই ধর্ম; পরম মনের পরিব্রাজক। বাংলা গানের সহজ, অকৃত্রিম ও অবিচল ¯্রােত থেকে উঠে এসেছেন গৌরাঙ্গ আদিত্য। কৃষ্ণলীলার গায়েন থেকে হয়েছেন যাত্রার বিবেক গায়ক। নিয়ম-মতো বিনয়, প্রাচীন আথিত্য, আত্মধর্ম ও লোকাচারে মগ্ন হতে হতে হয়েছেন ‘প্রান্থ জনের সখা’।
দুই/
আমাদের সকল আয়োজন ও আনন্দ বিন্যাসে যুক্ত থাকে স্বার্থপরতা। আমরা যে কতটা আত্মকেন্দ্রী সুর ও সংগীত সেটা বুঝতে দেয় না। ক্লান্তি কিংবা অবসাদের কোন মাথামুÐু নেই। ভেতরের যতো জেদ, হিংসা, ক্রোধ, গøানি ও অভিমানকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয় গান। গানের আসরে বসতে জানলে ধোয়ামোছা হয়ে হালকা মন একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে। জীবনের ভারে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদতে হয় না। গানের সুরে ও কথায় চোখ ভিজে গেলে শান্তিই নামে; আনন্দই নামে। জীবনকে যাপনের একক কোন ফর্মুলা নেই। শুধু বলা যায় সংগীতে শান্তি পাওয়া যায়। সুরের আশ্রমে সমর্পিত হওয়া যায়। ভাটির এই পলল ভূমিকে; দোলনচাঁপার নরম মাটিকে অনেকেই বলেছেন পাÐব বর্জিত দেশ। নিন্দুক মনের শুমারীতে এই হলো ইতিহাসহীন কৈবর্ত জাতির ভবিতব্য।
আজ যে কেউ বলতে পারে জীবনের মূল প্রশ্নগুলোই এরা বুঝেনি। যেহেতু আমাদের ইতিহাস লেখার অভ্যাস নাই তাই কেউ পুঁথিতে তুলেনি আমাদের ইতিহাস; হাজার বছর ধরে অবহেলায় গড়িয়েছে পূর্বপুরুষের শ্রম ও প্রাচুর্য। এই অনার্য দেশেও গুরুমুখী সংগীত শিক্ষার প্রচল ছিলো। সিদ্ধাচার্যদের চর্যাগান, শ্রীকৃষ্ণ ভিত্তিক পালাগান, মঙ্গলকাব্য, বিচ্ছেদী সুর কিংবা গীতিকার বিপুল ভাÐার একদিনে রচিত হয়নি। ভূপ্রকৃতির অকৃত্রিম আয়োজনেই তৈরি হয় মাটির সংগীত। এই সংগীত সাধনায় বিজ্ঞাপন পোস্টারে নাম না লিখিয়ে অনেকেই কালের ধূলি-কণায় হারিয়ে গেছে। সাধনা ও বিজ্ঞাপন সমান্তরাল নয়। সাধুর নৌকায় সাধকই থাকেন। আপন অন্তরালে গৌরাঙ্গ আদিত্য ভারতীয় সুর সাধকের নির্জন পথেই হেঁটেছেন। এই সাধনা সংগীত শেখার সাধনা। গান লেখা ও গাওয়ার সাধনা। পেশাজীবী হয়ে গেয়েছেন বিবেকের গান; কিন্তু মনের ভেতরে ছিল ‘মার্গ’ সংগীত শেখার প্রয়াস ও আয়োজন। যাপিত জীবনের নিত্যতায় এই প্রয়াস মুছে যায়নি। চর্যা ও মগ্নতায় ফল্গু ধারার মতো বহন করেছেন ‘মার্গ’ সংগীতের সাধনা।
সকল সংগীত শাস্ত্রেই দুই ধারার সংগীতের উল্লেখ দেখা যায়- মার্গ সংগীত এবং দেশি সংগীত। সকল গ্রন্থিকেরাই ‘মার্গ’কে ওস্তাদি সংগীত আর দেশিকে ‘গ্রাম্য’ সংগীত বলেছেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মতে-
‘মার্গ’ ওস্তাদী সঙ্গীত, আর ‘দেশী’ গ্রাম্য সঙ্গীত, একথা বলিলে বোধহয় নিতান্ত অন্যায় হইবে না। প্রাচীন কালে হয়ত এইরূপ বিভাগই হইয়াছিল। তখনকার ওস্তাদী সঙ্গীতকে মার্গ সঙ্গীত বলিত। গ্রন্থকারেরা সকলেই বলেন, ব্রহ্মা এই সঙ্গীতের ‘অণে¦ষণ’ করিয়াছিলেন। অর্থাৎ তিনি হয়ত অধ্যয়ন, সাধন, পরীক্ষা, বিচার প্রভৃতি দ্বারা সর্ব্বপ্রথমে বৈজ্ঞানিক সঙ্গীতের সূত্র-সকল নির্ণয় এবং লিপিবদ্ধ করিয়া থাকিবেন। সে সঙ্গীত যেমন বিজ্ঞানসম্মত, তেমনি বোধহয় জটিল ও কঠিন ছিল। সাধারণ লোকের তাহা ভাল লাগিত না, ওস্তাদেরাও হয়ত অতিকষ্টে তাহার অভ্যাস করিতেন, আর প্রায়ই তাহার জটিলতার জালে পড়িয়া নাকাল হইতেন। যে কারণেই হউক, উহার নিয়ম সকল সম্যকরূপে পালন না হওয়াতে তাহাদের বন্ধন ক্রমেই শিথিল হইয়া আসিল, তাহার ফলে সঙ্গীতের চেহারাও বদলাইয়া গেল। সুতরাং পরবর্ত্তী সময়ের ওস্তাদী সঙ্গীত আর ঠিক সেই মার্গ সঙ্গীত রহিল না। কাজেই সেই যে ‘অতিশুদ্ধরূপং’ সঙ্গীত তাহা ‘সাম্প্রতং নৈব গোচরম্’ পরবর্ত্তী সঙ্গীত আচারভ্রষ্ট হইয়া মার্গ নামের অযোগ্য হওয়াতে নিষ্ঠাবান ওস্তাদেরা তাহাকে দেশীর সামিল করিয়া লইলেন। এইরূপে ‘পূর্ব্ব প্রসিদ্ধ’ সঙ্গীত মার্গ, আর অধুনা প্রসিদ্ধ’ সঙ্গীত দেশী হইয়া দাঁড়াইল। [২]
ভারতীয় এই ধ্রপদ কিংবা মার্গ সংগীতই শিখতে চেয়েছিলেন তিনি। সুরের পাশেই বসতে চেয়েছিলেন জীবনের ভোরবেলা। কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে স্বপ্ন। বাস্তবতার বর্তমানে নিজেকেই খুড়তে হয় নিজের সমাধি। আক্ষেপ সংযুক্ত কলমি ফুলের মতো মানুষের মনটা নড়তে থাকে অবিকল। এই ধ্রপদী সংগীত শেখার জন্য ময়মনসিংহে ওস্তাদ বিজনকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের কাছে গিয়েছিলেন। নিবেদিত মনে শিখছিলেনও। মনের ভেতরে ধীরে ধীরে প্রচ্ছন্ন হচ্ছিল সুরের প্রতিমা। কিন্তু নির্মাণ আর সৃষ্টি-সাধনার নির্জন পথ থেকে ডেকে নেয় জীবিকার আহŸান। জীবন আসলে শঙ্খ ঘোষের কবিতা-‘ রাত্রির কলস ভেঙ্গে প্রভাত গড়ায় দিকে দিকে’। নিদারুণ অভিঘাতে কে সনাক্ত করে চোখের জল। তবুও কথাতেই লেগে থাকে মনের দাগ। যতই গভীরে যাই- দেখি গানের প্রতি বিভান্বিত; গান গাইতে না পারার আক্ষেপ। স্মৃতি তর্পণের উঠোনে বসে তিনি ফিরে যান আত্মজীবনের সংগীত পাতায়। সেখানে নিহিত থাকে গুরুনিষ্ঠা। গৌরাঙ্গ দা বলেনজানেন, গান শিখতে চেয়েছিলাম। ধ্রপদী ধারার ভারতীয় গান। জীবনে সব হলো। গানটা আর শেখা হল না। যাত্রা দলের বিবেক হয়ে গেলাম। মানুষে বলে ‘বিবেক সম্্রাট’। মানুষ খুব প্রশংসা করে। হাততালি দেয়। আমার জীবিকা ও পরিচিরি মূলে আছে বিবেক গান। কোন সন্দেহ নেই; এই গান আমি অন্তর থেকে গেয়েছি। অন্তর থেকে গাইতে না জানলে কেউ শিল্পী হতে পারেন না। বিবেক গান আমি অন্তর থেকেই গেয়েছি। কিন্তু আমি গান শিখতে চেয়েছিলাম। এই শেখাটাই হলো না।…………
আমি এমন গান গাইতে চেয়েছিলাম যে গান সবাই গাইতে পারবে না। সেই লক্ষেই ময়মনসিংহে গুরুগৃহে গিয়েছিলাম। সেখানে পাঠিয়েছিলেন আমার আরেক গুরু গোঁসাই পাড়ার বীরেন্দ্র চন্দ্র গোস্বামী। চিঠি লিখে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমার কথা বলবি’। সব শুনে গুরু বললেন, ‘ তোকে শেখাবো। প্রেম নিয়ে থাকতে পারবি’। আমি বলেছি পারবো। প্রেম নিয়েই থাকতে পারবো। প্রেম নিয়েই গুরুর গৃহে ছিলাম। ধীরে ধীরে প্রবেশ করেছি গুরুর বিভায়। ত্রিশালে লজিং থাকতাম। সাপ্তাহে দুদিন গুরুর বাড়িতে যেতাম। গুরুর নির্দেশিত পথে হাঁটতাম। কিন্তু লজিং বাড়িতে চিঠি আসলো। বাবা লিখেছেন চিঠি। আমাকে ফিরতে হবে। বাবা, কৃষ্ণলীলা পালার জন্য অগ্রিম বায়না নিয়েছেন। আমি পরিবারের অবস্থা জানতাম। সব জলাঞ্জলি দিয়ে ফিরে এলাম। একটা কথা বলি, আমি কিন্তু খালি হাতে ফিরিনি। গুরু আমাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। এমন একটা রাগ তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন যে রাগটা সব সুরের সার। এই ‘রাগ’ দিয়েই আমি সব গান উঠাতে পারি। আমি জানি, আমার সাথে গুরুর প্রেম ছিল; গুরুরও আমার সাথে প্রেম ছিল। প্রেম না থাকলে এমন একটা রাগের সন্ধান তিনি দিতেন না।
তিন/
সম্ভবত গৌরাঙ্গ আদিত্য গান রচনার ভার গ্রহণ করেছেন জীবন সায়াহ্নে। যখন তিনি যাত্রার উজ্জ্বল মঞ্চ থেকে বিবেক-গায়ক হিসেবে অবসরে গেছেন। কিংবা তারো আগে বিবেক গান গাইতে গাইতে মনের ভেতরে উঁকি দিচ্ছিলো কথা ও সুরের কল্পনা। এটা কোন অনায়াস ঘটনা ছিল না। কতদিনের কত আয়োজনে জন্ম নিয়েছে সুর ও কথাকলি। বহমান রক্তে নিংড়ানো থাকে কথা ও অভিজ্ঞতা। শিল্প হচ্ছে অভিজ্ঞতা। কত যে বিচ্ছেদ শান্ত ও নিভৃত সকালে উঠে আসে গানের কথা। সারা জীবন, দীর্ঘ জীবনের অপেক্ষার পর অন্তিমে এসে শিল্পীর অভিজ্ঞতা থেকে জাত হয় মহৎ কয়েকটি গান। একটি থেকে অন্যটি ভিন্ন করে চেনা যায় তখন। জীবনের অভিঘাত গুলোই মহৎ আর দুর্লভ মুহূর্তে গান হয়ে উঠে। প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় নিজেকে সম্পূর্ণ করার নাম শিল্পীর ব্যক্তিত্ব।
শাস্ত্রীয় মার্গ সংগীত, দেশি সংগীত এবং যাত্রার লোকগানের অভিজ্ঞানে পরিশোধিত হয়েছে গৌরাঙ্গ আদিত্যের সংগীত জগৎ। তিনি বিশ^াস করেন সংগীত গুরুমুখী বিদ্যা। গুরু ছাড়া অন্তর জাগ্রত হয় না। সাধনা ছাড়া অন্তর জাগ্রত হয় না। শুরু ভক্তের অন্তরে সাধনার পথ ও পদ্ধতি প্রকাশ করেন। পিতার হাতেই সংগীতের হাতেখড়ি হয়েছিল। শৈশবে সংগীতের গুরু ছিলেন বীরেন্দ্র চন্দ্র গোস্বামী। বীরেন্দ্র চন্দ্র গোস্বামীই শিষ্যকে ময়মনসিংহে ওস্তাদ বিজনকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের কাছে পাঠান। সেখানে তিনি সাপ্তাহে দুদিন করে একবছর গুরুর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখেন। সর্বশেষে তিনি ওস্তাদ গোপাল দত্তের সংগীতাশ্রমে উচ্চাঙ্গ সংগীতের সার্বিক তালিম নেন। গোপাল দত্তের সান্নিধ্যে এসেই তিনি গান রচনায় ব্রতী হন। দৃষ্টি ও সৃষ্টিতে পৃথিবী দেখার এ এক প্রকৃত কাজ। নিজের ওস্তাদ সম্পর্কে প্রণত চিত্তে তিনি বলেন, জীবন সায়াহ্নে এসে আমি গান লেখালেখি শুরু করেছি। শুধু গান নয়; অনেক কিছুই তিনি আমাকে শিখিয়েছেন। ভাল-মন্দ সব কিছুই। উনি আমার জীবনে শান্তির বাতায়ন ছড়িয়ে দিয়েছেন। ওস্তাদ আমাকে অন্তরে নিয়েছিলেন। গুরু অন্তরে নিলে শিষ্যের পথ হাঁটা সহজ হয়ে যায়। উনার সান্নিধ্যে না আসলে আজকের এই আমি গৌরাঙ্গ আদিত্য হতে পারতাম না। তিনি অনেকটা অডিশন নেয়ার মতো করে আমাকে গান লেখার পথে নামিয়ে দিলেন। ধরেন তিনি প্রথম লাইনটা বললেন; বলে দ্বিতীয় লাইনটা কি হবে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। যেমন তিনি ‘আমার এই দুঃখের ঘরে’ বলে বললেন পরের লাইনটা কি হবে বল দ্বিতীয় লাইনটা কী হবে বল; আমি বললাম- ‘আমার এই দুঃখের ঘরে সুখের প্রদীপ’। তিনি বলতেন, বাহ! পারবা । লেইকখো মিয়া। নিজে লেখবা, নিজে সুর করবা, নিজে গাইবা। তাহলে কেউ বলবে না এর মত হয় নাই। ওর মত হয় নাই। লেইকখো। উনি আমাকে সামনে বসিয়ে সুর করতেন। একলাইন তিনি নিজে সুর করলেন। পরের লাইন আমাকে সুর করতে বললেন। আমি সুর করার পর বললেন ‘চলবে! চলবে!। অভ্যাস করতে হবে। লেগে থাকতে হবে’। এক কথায় সংগীতের পথে আমাকে নিয়ে এসেছেন আমার গুরু ওস্তাদ গোপাল দত্ত। গুরুর কৃপাতেই আমার এই অর্জন।
চার/
গৌরাঙ্গ আদিত্য সচেতন ভাবে গানই লিখতে চেয়েছেন। গানের কথায় হয়তো কবিতার মতো আচ্ছন্নতা নেই; নেই ইমোশন। কিন্তু সুরের ভেতরে, কথার ভেতরে আছে জীবন পরিপক্কতার রঙ; নিগূঢ় জীবন। অভিজ্ঞানের সৌরভে প্রতিটি গানই অন্তরের অন্তঃপুর থেকে উঠে এসেছে। সুর মাখানো সাধারণ এই কথাগুলো যেন পরীক্ষিত চাঁপাফুল। যতক্ষণ বাঁচে চাঁপাফুল ঘ্রাণ ও সৌরভ ছড়ায়। যেন সুরের একটা সমুদ্রে জীবন ভাসছে। ভাব-ভাষা-সুরে কাব্যিক মানুষের প্রতিধ্বনি না থাকলেও আছে জীবনের নির্জন বেদনারস। গান ও কবিতার পার্থক্য সম্পর্কে ড. সুকুমার সেন বলেন-
কবিতা ও গানের পার্থক্য মোটামুটি আপনারা সবাই জানেন। তবুও আমার দৃষ্টি অনুসারে একটু বুঝিয়ে বলা আবশ্যক মনে করি। আকারে এবং প্রকারে গান ও কবিতা যথাক্রমে ছেলে এবং বুড়ো মানুষের মতো। গান আকারে ছোট, প্রকারে চঞ্চল; কবিতা আকারে ছোট হতে পারে, বড়ও হতে পারে। কিন্তু আকারের এ প্রভেদ বাহ্য। আসলে কবিতা ও গান যেন পশু ও পাখি। পশু, যেমন ঘোড়া, উধাও ছুটতে পারে-মাটিতে। পাখি নিরুদ্দেশ উড়তে পারে-আকাশে। ঘোড়দৌড়ের সীমা আগে, পাখির ওড়া শেষ দিগন্তের বাইরে। পাখির এই বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে তার দুটি পাখায়। গানের দুটি পাখা হল সুর ও তাল। সুরের তালের উপর ভর করে গানের অর্থ
বাক-এর বাঁধন কেটে অবাকের সীমাহীনতায় হারিয়ে যায়-গভীর অনুভূতিতে। কদাচিৎ কবিতাতেও এমন সীমাহীনতার কিছু ইঙ্গিত হয়ত পাওয়া যায়। তবে তা অনুভূতিতে নয়, ভাবনায়, কল্পনায়। এমন কবিতাকে বলতে পারি পক্ষীরাজ ঘোড়া। তবুও সে পাখি নয়, ঘোড়া; সে কবিতাই গান নয়।
অতএব গান কবিতার উর্ধ্বে। কবিতার জগৎ তিন আয়তনের বা তিন ডাইমেনসনের-বাক্ অর্থ ও ছন্দের। গানের জগৎ আইনস্টাইনের বিশে^র মতো চতুরায়তন অর্থাৎ চার ডাইমেনসনের-বাক্ অর্থ তাল (ছন্দ) ও সুরের। [৩]
গৌরাঙ্গের গান না আবেগের; না প্রজ্ঞার। প্রেম ও প্রেমাষ্পদের সাথে মিলনের ব্যকুলতাই তার গানের ধর্ম। সামাজিক, বাচনিক, ধর্মগুরু, গুরুভক্তি বিষয়ক গানও লিখেছেন। এইসব গান মনের ¤øান ও ময়লাকে পরিষ্কার করে দেয়। ভেতরে সুরের বিকিরণ না থাকলে গানের কথায় কেউ সুর বসাতে পারে না। নিজের জন্য আর কে লিখেছেন গান। গৌরাঙ্গের গানের কাছাকাছি আসলে বুঝা যায় ভাসা ব্যাপার নয়; নয় আত্মকেন্দ্রিকতা। প্রেম ও আক্ষেপই তার সুরের সম্বল। প্রেম ও মঙ্গলের ধারণা নিয়ে প্রতিটি সুরেই আছে আত্মোন্মোচন। কথায় ও সুরে গৌরাঙ্গ আদিত্যও যেন মহুয়া ও নদের চাঁদের মতো চোখ মুছে। নদের চাঁদ যেমন বলে ‘কোথায় পাব কলসি কন্যা, কোথায় পাব দড়ি তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুইব্যা মরি।’ রাবীন্দ্রিক ভাবনায় নয় হাওরাঞ্চলের মানুষ এভাবেই কথা বলে। প্রেমের এই অমৃত-কথন থেকেই শক্তি ও দীপ্তি নিয়েছেন গৌরাঙ্গ আদিত্য। আত্মামাখানো স্বরে তিনি গাইতে থাকেন-
যদি মইরা যাই, বন্ধু কোন ক্ষতি নাই,
শুধু তোমারে আমি যেন, শিয়রেতে পাই।
কানতে কানতে ঘুমের ঘোরে, স্বপনে দেখি তোমারে,
ঘুম ভাঙ্গিলে দেখি তুমি নাই
তুমিতো আমারই বন্ধু, জনমে জনমে,
তুমি ছাড়া আর কে আছে গোকুলে তিন কালে।
আমার দুঃখের ঘরে আগুন দিয়া, কাইল বলে গেলে চলিয়া,
সেই কাইলের কি কাল ফুরায় নাই
পাঁচ/
ভক্তি ও ভাবুকতাই গৌরাঙ্গের শক্তি। প্রেমভক্তিবাদী রূপটিই উন্মোচিত হয়েছে গৌরাঙ্গের গানে। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনকে নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজ কতৃক খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়। সেই বকুলতলায় নাট্যকার সেলিম আল দীন ডায়রির প্রথম পৃষ্টায় একটা অটোগ্রাফ দেন। এর কয়েক বছর পরেই সেলিম আল দীন পরলোক গমন করেন। বেদনায় ও শোকে গৌরাঙ্গ দা লিখেন প্রেমগান। এ যেন রাধা-কৃষ্ণের প্রেম। সামাজিক দরিয়া থেকে মুক্তির মন্ত্রণা।
মন মজাইয়া প্রেম শিখাইয়া, দিলা শুধু যন্ত্রণা।
প্রবোধ না দিলা আমায়, না দিলা সান্তনা।
পাখীর মত উইড়া উইড়া, কতখানে যাই,
তোমারে না পাইয়া বন্ধু, কাইন্দা বুক ভাসাই।
সারা জনম খুঁইজ্যা তোমায়, আর কি পাইতাম না।
কার ডাকেতে সাড়া দিয়া, বৈদেশেতে গেলা,
আমার যে কি হইবো বন্ধু, একবার না ভাবিলা।
কেমনে তোমার চরণ পাইতাম, দিলনা কেউ মন্ত্রণা।
সব খোয়াইয়া গৌরাঙ্গ, তোমারে স্মরিয়া,
হাহুতাশ আর হায় হায় কইরা, শান্তি চায় মরিয়া,
কালার প্রেমের এমন জ¦ালা, আগেতো জানতাম না।
(ড. সেলিম আলদীন স্মরণে।)
শুধু রোমান্টিকতা, বৈষ্ণববাদ কিংবা লোকগানের প্রভাব বলে গৌরাঙ্গের গানকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-কোল-মুÐা প্রভৃতি হল সংকর বাঙালির আদি পুরুষ। আর্য রক্তের মিশ্রণেই কৃষ্ণবর্ণ বাঙালির গাত্র গৌড়বর্ণ হয়েছে। শ্যামল বাঙালির সাজানো আবহাওয়ার ভেতরেই আছে প্রেম ও বিচ্ছেদের অন্তরঙ্গ হাওয়ায়। সেই হাওয়ায় ভাটির রাধারমণ কিংবা উকিল মুন্সি অবিদিত নয়। সুরে ও স্বরে পূর্বপুরুষের বীজতলা থেকেই ঘুরে এসেছেন গৌরাঙ্গ আদিত্য। নিদয় বন্ধু দয়া কইরা,“ দেখা দাও আমারে”।
দিনে দিনে দিন চইল্যা যায়, পাইলাম না তোমারে।
তোমার দেখা পাবো বইলা, পথে বইসা থাকি,
মনের দুঃখ মনের মাঝে, পাতা চাপা রাখি।
শিল্পীদের মূলত অহংবোধই সম্বল। আর কিছু না থাকলেও শিল্পীদের সকাল শুরু হয় চাঁপাফুলে, সন্ধ্যা কিংবা রাত আসে বেলফুলে। জঞ্জাল, গøানি, পরিতাপ, হীনতা, হিং¯্রতা, জৈবতার মধ্যে সংগুপ্তে বাঁচেন শিল্পী। কে বলবে, সময় কাকে ভাবীকালের দিকে সরিয়ে নিয়ে যাবে। কাকে বলে শিল্পের চিরায়ত মাধুর্য; এ নিয়ে হয়তো প্রচুর লেখা হয়েছে, কিন্তু সর্বমান্য ধারণা কি আছে! জীবন শেষ হয়; শেষ হয় প্রত্যেকের দেখার কদম তলা। মৃত্যুর অনেক পরে ছাপা হয় জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’। তাই বলি, মানুষের ভাষা ও কল্পনার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। সামাজিক নিত্যতার ভেতরেই থাকে জীবনের সুর। সেই সুরেই ¯œাত আছেন গৌরাঙ্গ আদিত্য। সময় ও মাটির একটা বীজতলা থাকে। সেই বীজতলাতেই সন্তর্পণে পূর্বপুরুষেরা রেখে যান অর্জিত জ্ঞানের ঐশ^র্য। মোহনগঞ্জ কিংবা ভাটি অঞ্চলের মাটি মূলত বিচ্ছেদী গানের রঙ্গশালা। রাধারমণ কিংবা উকিল মুন্সিরা বিচ্ছেদী গানের চিরায়ত মাটির ধারাকেই বহন করেছেন। নিজস্ব নীরবতায় সুরের জগতে সুস্থির আছেন গৌরাঙ্গ আদিত্য। স্টোকের পরে নিশ্চল। হুইল চেয়ারে বসে নিজেকেই খুলে খুলে দেখেন। ভোরের ফুলের মতো যে জীবন একটু একটু করে বিকশিত, সে জীবনকে দেখেন। ভারতীয়রা পুনর্জন্মে বিশ^াস করে। সে বিশ^াসেই গৌরাঙ্গ দা গাইতে থাকেন- যদি মইরা যাই, বন্ধু কোন ক্ষতি নাই, শুধু তোমারে আমি যেন, শিয়রেতে পাই।
তথ্যসূত্র:-
১. আহমদ শরীফ সম্পাদিত, বাউল কবি ফুলবাস উদ্দীন ও নসরুদ্দীনের পদাবলী (ঢাকা বাংলা একাডেমি, ১৯৮৮), পৃষ্টা ১৯৫
২. দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, ভারতীয় সঙ্গীত, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (কলকাতা সূত্রধর, ১২ মে ২০১৩) পৃষ্টা ৩৫-৩৬
৩. সুকুমার সেন, রবীন্দ্রনাথের গান, টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলকাতা পৃষ্টা ১৮-১৯