সৃষ্টিকর্ম কবির কাছে পরিপক্ক মনে হলেই মলাটে আবদ্ধ হয়। কবিতা উপলব্ধি করা পাঠকের সংখ্যা সারা পৃথিবীতেই নগন্য। কবিতা সমালোচনার মতো দূর্বোধ্য বিষয় জগতে খুবই কম। কবিতার বৈচিত্র্যময়তা আমাকে মুগ্ধ করে। কবিতা আমার মতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্প। আবার কখনও মনে হয় কবিতা নিছক ঘোরলাগা এক সময়ের সংলাপ!
একজন নবীন লেখকের মগজে আবেগের প্রাধান্য থাকাটাই স্বাভাবিক। চিন্তার গভীরতা আর রোমান্টিসিজমের সাথে এখানে প্রকাশ পেয়েছে সামাজিক নানা অসঙ্গতি। কাল্পনিক অথরাকে ঘিরে ২০১৯ এ প্রকাশিত ৪২ টি কবিতার সমন্বয়ে “জলঘুমে অথরা” সৌহার্য্য ওসমানের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। তিনি দেশের নবীন কবিদের মধ্যে অন্যতম প্রতিভাবান কবি। আন্তর্জাতিক ভাবেও পরিচিতি পেয়েছে তার এই কাব্যগ্রন্থটি। ওপার বাংলা ও আসামেও সমাদৃত “জলঘুমে অথরা”। সাম্প্রতি অসমীয়া ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে কাব্যগ্রন্থটি।
প্রথম কবিতা ‘দেয়াল’
‘তারপর আমার সবটুকু শুদ্ধতা কেড়ে নেয়!’
মধুময় শৈশব স্মৃতি আর বর্তমানের গতিময়তা তৈরী করে সময়ের দেয়াল। জোছনা রাত, টিকটিকির শাব্দিক ছন্দ, নিস্তব্ধ আকাশের নি:সঙ্গ তারকারাজি, শহরের নিয়ন বাতি, শীতের ঘন কুয়াশা, সবুজ ঘাস সবকিছুকে পর করে দিয়েছে বাস্তবতার অদৃশ্য কালো দেয়াল। এই অদৃশ্য কালো দেয়ালটি আমরা সবাই বুকে ধারণ করেই জীবন সংগ্রামে এগিয়ে চলেছি।
আমাদের সংস্কৃতিতে সবার প্রিয় আয়োজন বলতে বিবাহের অনুষ্ঠানকেই বুঝে থাকি। সুঘ্রানে মুখরিত বাহারি খাবারের সাথে মিষ্টি আর পান অন্যতম ঐতিহ্য। বাহারি রঙ্গিন আলোয় অথরার নতুন জীবনের সুখের সূচনা হলেও সমান্তরাল ভাবেও ‘মিষ্টি পানের সুখে’ রচিত হয় যুবকের করুণ অধ্যায়।
ক্ষ্যাপাটে মেঘের গর্জনের মাঝে ‘আয়োজন’ কবিতারই প্রচ্ছন্ন ভাব প্রস্ফুটিত। ইচ্ছার বিরুদ্ধে অথরাকে অচিন পৃথিবীর বাসিন্দা হতে হয়। কখনও কখনও মেঘেরাও ফড়িং এর সাথী হতে চায় না । আবার মন পবনের নাও মেঘের ভেলায় অথরার নতুন পৃথিবী দেখতে চায়।
‘সাহসে সাহসেই যৌবন কেঁপে ওঠে
থালায় পড়ে থাকে চাঁদমাখা ভাত’
‘বালক সময়’ একটি সাহসী কবিতা -প্রকৃতিকে বিপন্ন করে নির্মাণযজ্ঞ চাইনা । ধরণীর সবুজ মুছে উন্নয়ন নয়।
টিআর, কাবিখা- মেরে দিতে পারলেই কাগুজে উন্নয়ন বাহবা পেতে পেতে মিথ্যাচারই নিয়ম হয়ে যায়। বিশাল অংকের বাজেট মানেই উন্নতি নয় এমন প্রহসন নিয়েই বালকের জন্য কবিতা।
বংশানুক্রমিক পরম্পরায় দাদার সাথে স্নেহ-শাসনের স্মৃতি, কবর দেশে চলে যাওয়া কিংবা পিতার সাথে স্মৃতিকাতরতা ফুটে উঠেছে ‘পিতার জন্য’ কবিতায়।
শহরের বুকে জীবন্ত একটি বিল । কালের স্বাক্ষী ঢলুয়া বিল। বিল হত্যা করে লোকালয় বানানো, অথরার মতো আমাকেও ব্যথিত করে। সত্যিই তো-
প্রতিটি বিল মানেই এক একটা গল্প।
কাউকে তো অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে বিবেকের ঘুম ভাঙাতেই হয়। নতুন চেতনা নিয়ে দলবেধে ভ্রমন করতে না পারলেও অথরাকে কেন্দ্র করে মেতে উঠে মোড়ের চা-আড্ডা।
আমাদের নগর জীবন গ্রাস করেছে ছিন্নতা আর কৃত্রিমতা অথচ আমাদের পাবার কথা ছিল মাটির সুঘ্রাণ। নগরের অমানবিক জীবনে সবাই যেন এক অদৃশ্য কারাগারে বন্দি।
‘গাছ বেঁচে থাকে অথরার ঠোঁটে’
ঊষর ধরণীতে প্রথম প্রাণের আবির্ভাব বৃক্ষ, বৃক্ষ পৃথিবীর আদিমতম সন্তান। গাছের কাছে ধৈর্য্য আর পরোপকারীর সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষা নেয়া যায়। ডালের পাতার ন্যায় মিলে মিশে যাপন আর সম্মিলনেই মাঝেই নিহিত জীবনের সার্থকতা। সত্যিকারের মানুষ হবার আহবান কবিতায় চমৎকারভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
‘অথরা তোমার ভেতর খুলে দাও’
ঈড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর কিংবা গঙ্গা- যমুনা- ভগীরথী শ্রুতিময় শব্দের পাশাপাশি ছোট্ট ত্রিমোহিনী শব্দটি নির্দিষ্ট একটি স্থানকে বুঝালেও কবিতায় এসেছে বিশালাকার জলরাশির পরিচিতি নিয়ে। এখানে কবির দক্ষতার সুনিপুন কারুকার্য্য প্রশংসনীয়। আয়মানের তীর ঘেষে পৌর মহাশ্মশান। সবুজের সমারোহ বিনষ্ট করে গড়ে তোলা হাটের নাম নতুনবাজার। কবি স্বপ্ন দেখেন আবারও সবুজের সমারোহে ভরে উঠবে প্রিয় ত্রিমোহিনী।
‘‘বর্ষার মেঘের ভেতর থেকে লুকিয়ে থেকেও শুদ্ধতা
হাওয়ায় দুলে, হেলেদুলে মুচকি হাসে
বাঁকা হাসি”–
চলমান বাস্তবতা আর মানুষের প্রতি মমতা দেখা যায় ‘রাখাইন রাত’ কবিতায়-
মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের কবিদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছিলেন রোসাঙ্গ রাজাগণ। মহাকবি আলাওল, দৌলত কাজী, সৈয়দ সুলতান, মুহম্মদ খান, হাজি মুহম্মদ প্রমুখ কবিদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আরাকানের রাজারা। সেই পূণ্য ভূমিতেই পিশাচের নির্মমতার কাছে বাস্তুচ্যুত নিরীহ রোগিঙ্গারা। পূজিবাদের লুলোপতার শিকার শান্তিপ্রিয় মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল নাফ নদীর শান্ত জল। এখনও রক্ত পিপাসায় ঝাপিয়ে পড়তে চায় বার্মিজ বুলেট।
সংস্কৃতির বিবর্তিত রূপ দেখতে পাই ‘রবিবার’ কবিতায়-
পোড়া মরিচের ভূত পালনো ঘ্রাণ, বাকীর হিসাবের লাল সালুখাতা হারিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি বিস্মৃত করে আপন হয় বেনারসি আর পশ্চিমা কালচার।
প্রকৃতির রূপরসের সমাহার জলমুমে অথরা-
কলমির লিকলিকে সবুজ, ডানামেলা কবুতর, পূর্ণ জোছনা, তালপাকা ভাদ্র, নি:সঙ্গ কবর, ডুমুর ফুলের মতো উপমা কবিতাটিকে বাংলা কাব্যে উচ্চতর স্থান দিতেই পারে।
সত্যিই তো জীবন এক রঙিন ক্যানভাস। আয়তাকার সরল ফ্রেমে হাজারো স্মৃতির ঢেউ দোল খায়।
আমারও বৃষ্টি ভাল লাগে। কবির মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করে-
‘বৃষ্টির চেয়ে ভালো কিছু
যেন নেই পৃথিবীতে’
আন্দোলনের মাধ্যমেই সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন কবির। কলম বজ্রসম শক্তি ধারণ করলেই পরিবর্তনের জোয়ার সম্ভব।
নালিখালি একটি নিভৃত পাহাড়ি গ্রাম অথচ প্রতিনিয়ত চলে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয় ডালিম ফাটার মত।
বসন্তের আকাশ-এ কবি অথরার মনের মেঘলা অকাশটা দেখারও অগ্রহ প্রকাশ করেন।
অথরা অজও সুবাসিত সমস্ত ফুলের
সেই গন্ধের অপেক্ষায়।