প্রকৃতির সৌন্দর্য্য অবলোকন করে মানব মন যখন বিমুগ্ধ, বিস্মিত ও বিমূঢ় হয়ে যায় তখন সে তাকে নিজের মধ্যে আপন করে পেতে চায়। এরই ধারাবাহিকতায় সে চায় এই নৈসর্গিকতাকে একটি স্বাভাবিক রুপ দিতে। আর এর মাধ্যমেই জন্ম হয় শিল্পের।
যার মন সুন্দর সে যেকোন বস্তুর মধ্যে সৌন্দর্য্য বা নন্দন খুঁজে পায়।
মূল
আমাদের শিল্প সম্পর্কে না জানলেই নয়।
শিল্প হল সৃষ্টি। শিল্পীর হাতের সৃষ্টি। চিরায়ত ও চিরন্তন নৈসর্গিক প্রকৃতিকে শিল্পীর নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত রং, রেখা, শব্দ বা রূপকের আশ্রয়ে প্রকাশ করে সেই অনুভূতি অন্যের মনে সঞ্চারের মাধ্যমে একটি পরিচয়বোধের সঞ্চারণ ঘটানোকেই শিল্প বা Art হিসেবে অভিহিত করা হয়।
শিল্প আবার দুই ধরনের-
১) শিল্পের জন্য শিল্প ও
২) জীবনের জন্য শিল্প।
আর জীবনের জন্য যে শিল্প তা হল লোকশিল্প।
আমরা একটু ব্যাখ্যা করলে দেখি-
লোকশিল্প যেমন: নকশিকাঁথা, শীতল পাটি, কাঠের তৈরি পানের বাটা, লোহার সরতা, তালপাতার পাখা ইত্যাদি। যারা এসকল জিনিসপত্র তৈরি করে তারা প্রান্তীক জনগণ। তারা এগুলো তৈরির মধ্যে একদিকে যেমন জীবিকা নির্বাহ করে অন্যদিকে ঠিক তেমনি তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার নানা চিত্র তুলে ধরে যা অর্থবহ।
এই লোকশিল্পের প্রতিটা অংশ খুটিয়ে দেখলে আমরা দেখব যে, সেখানে নানা ঘটনার নানান চিত্র ফুটে উঠেছে।
আমরা জানি
প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি আমাদের সমাজে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চলে আসছে। যার দরুণ নারীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত, অপমানিত, লাঞ্চিত হয়ে আসছে।একটা সময় ছিলো যখন নারীরা মুখ ফুটে তাদের সেই নির্যাতনের কথা কাউকে বলতে পারতো না। তাই, তারা নিজের হাতে তৈরি লোকশিল্পের মোটিফ গুলোতে সেই নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরত এভাবে,যেমন –
নকশীকাঁথা হলো মানুষের নিত্য ব্যবহার্য উপাদান। নকশীকাঁথা কেবল একটি কাঁথা নয়। এই নকশী কাঁথায় চিত্রিত প্রতিটি মোটিফ যেন নারীজীবনের এক একটি অধ্যায়কে বহন করে।
আসুন দেখি কীভাবে তা বহন করে…
প্রথমে আসি জ্যামিতিক মোটিফে,
জ্যামিতিক মোটিফগুলো হলো- বিন্দু, সরলরেখা, বক্ররেখা, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত, রম্বস ইত্যাদি ইত্যাদি ।
আবার নকশীকাঁথায় চিত্রিত এই জ্যামিতিক মোটিফগুলো নারীজীবনের এক একটি অধ্যায়কে বহন করে।যেমন-
০১. বিন্দু:
বিন্দু (.) ছোট একটা ফোটা। বিন্দু স্থির। নারীর বিবাহিত জীবন মানেই তাদের স্বাধীন জীবন এখানেই থেমে যাওয়া। বিবাহিত জীবনের পর স্বামীর বাড়িতেই তারা কর্মজীবন এখানেই শুরু এখানেই সমাপ্তি।
০২. সরলরেখা:
চলমান। সোজা। বিয়ের পর স্বামী, ননদ, শাশুড়ি, শ্বশুর যতই নির্যাতন করুক না কেন নারী পারে না সব ফেলে বাবার বাড়ি চলে আসতে। সব কষ্ট সহ্য করে নিজের জীবনটা এভাবেই চালিয়ে নেয়।
০৩. বক্ররেখা:
জীবন সরল নয়। বক্রতা আসবেই। নারীরা তাদের জীবনের দুঃখগুলো এই বক্ররেখার মাধ্যমে প্রকাশ করে।
০৪. চতুর্ভুজ :
চার কোণা ঘর। নারীরা বিয়ের পর চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে যায়( লোকশিল্পের মতে)। মৃত্যু ব্যতীত এই চার দেয়াল থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
নকশীকাঁথায় নারীরা তাদের চার দেয়ালে বন্দি থাকা গল্পগুলো চতুর্ভুজ দ্বারা প্রকাশ করে।
এবার যদি প্রাকৃতিক মোটিফ নিয়ে কথা বলি,তবে আমরা এখানেও নারী জীবনের এক একটি নতুন অধ্যায় প্রবেশ করবো-
০১. লতাপাতা:
সবুজ লতাপাতা । আর এই লতাপাতা অাঁকাবাঁকা। নারীজীবনও তেমনি আঁকাবাঁকা। কখনো সুখ, কখনো দুঃখ। নকশীকাঁথায় অঙ্কিত লতা পাতায় নারীরা তাদের জীবনের সে দিকটি ফুটিয়ে তোলে।
০২. ফুল:
বৈচিত্রময় সব ফুল । আমরা প্রকৃতিতে বিভিন্ন আকারের, প্রকারের ফুল দেখি। আর নারীরা এই ফুল দিয়ে এক একটি মানুষের চরিত্রকে তুলে ধরেছে বিভিন্ন সময়ে নকশীকাঁথায়।
নকশীকাঁথায় ব্যবহৃত সাদা সুতা প্রসঙ্গে যদি বলি,আমরা জানি যে,
সাদা পবিত্র বা শান্তির প্রতীক। নারীরা নকশী কাঁথাটি তৈরি শুরু করে সাদা সুতা ব্যবহারের মাধ্যমে। এক জায়গায় এসে এ সাদা সুতার সমাপ্তি হয়।
নারীরা শান্তিপ্রিয়। প্রবাদে আছে-বুক ফাটে তবুও মুখ ফোটে না।
নারীদের জীবনের এই নরীবতা বা শান্তিপ্রিয়তার পরিসমাপ্তি ঘটে সাদা কাফনের কাপড় পরিধানের মধ্য দিয়ে।
এভাবে লোকশিল্পে ব্যবহৃত প্রতিটা মোটিফ নারীজীবনের এক একটা অধ্যায়কে তুলে ধরে।
লোকজীবনের প্রত্যেকটি সৃষ্টিই জীবন-বাস্তবতার অনন্য শৈল্পিক নিদর্শন।